দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গভর্নর টাকা না ছাপানোর পক্ষে বলে এলেও অর্থ সংকটে ধুঁকতে থাকা ব্যাংকগুলোকে নতুন টাকা ছাপিয়েই সরাসরি সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; এরইমধ্যে দেওয়া হয়েছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা।
আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কথা নিজেও বলেছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর; তবে তা সাময়িক বলে তুলে ধরেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, টাকা না ছাপানোর আগের সিদ্ধান্ত থেকে সাময়িকভাবে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
“আমি আগে বলেছিলাম টাকা ছাপাব না। তবে সেই বিষয় থেকে আমি সাময়িকভাবে সরে এসেছি, পুরোপুরি নয়।
“গ্রাহকের টাকা নিরাপদ রয়েছে। তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোতে ২২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।”
সরকার পতনের পর আগের সুবিধাভোগীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কিছু ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ার খবরে সেসব ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িকের বিপরীতে আমানত রাখা বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাব খাটানো চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলম তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে সরকার পতনের আগে ও পরে বড় অঙ্কের তুলে নেয়।
ক্ষমতার পালাবদলের সময়েও ওই গ্রুপের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের টাকা তুলে নেওয়ার খবর আসে। এসব খবরে ব্যাংকগুলোর সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়। সবাই টাকা তোলার চেষ্টা করলে ব্যাংকগুলো আর গ্রাহকদের দিতে পারেনি। সেই থেকে সাড়ে তিন মাস পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।
নগদ টাকার অভাবে গ্রাহকের চাহিদা মত টাকা দিতে পারছে না ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনালসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক।
এমন অবস্থায় প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে গ্যারান্টার হয়ে সবল ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সহায়তার পদক্ষেপ নেয়। ছয় থেকে সাতটি ব্যাংককে কয়েক দফায় সাত হাজার কোটি টাকার মত দেওয়া হয়। তবে ব্যাংকগুলোর চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম।
এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোর সহায়তায় টাকা ছাপিয়ে গত ২৫ নভেম্বর সেগুলোকে সরাসরি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে খবরে এসেছে।
চলতি সপ্তাহে তারল্য সংকটে থাকা ছয় ব্যাংকে সরাসরি তারল্য সহায়তার বিষয়টি আলোচনায় ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর তা পরিষ্কার করলেন।
এর আগে একাধিকবার তিনি উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে টাকা ছাপিয়ে আর এসব ব্যাংককে সহায়তা দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছিলেন। এখন সেই অবস্থা থেকে সাময়িক সরে আসার কথা বললেন।
আহসান মনসুর বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে এই টাকা তুলে ফেলবে। বিল ছাড়ার প্রধান কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক হাতে তারল্য সহায়তা দিচ্ছে, আবার অন্যদিক থেকে তারল্য উঠিয়ে নিচ্ছে।”
আগের সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেওয়া সহায়তা আর এখন দেওয়া সহায়তার মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বোর্ড পরিবর্তন হয়েছে, টাকা চুরি বন্ধ হয়েছে। লাখ লাখ টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক থেকে যে লাখ লাখ টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে সেটা তো আর হবে না।”
তিনি বলেন, প্রতিটি ব্যাংক পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তাদের পারফরমেন্স নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
“আগে যেটা ছিল সেটা অনেকটা বাবার কাছে ললিপপ চাওয়ার মত। টাকা চেয়েছে আর দিয়েছে। কোনো অ্যাকাউন্টটিবিলিটি ছিল না। ইসলামী ব্যাংকেইতো ৩০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তাতে কী লাভ হয়েছে? টাকা তো সিঙ্গাপুরে পাচার করা হয়েছে। তাই এখন আর সেসব হবে না।”
তিনি দাবি করেন এক দিক থেকে টাকা দেওয়া হচ্ছে অন্যদিক থেকে টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। তাতে সার্কুলেশন বাড়ছে না।
”নেট ব্যাসিস টাকা বাড়ানো হচ্ছে না। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না, যা মুদ্রানীতির পরিপন্থি নয়।”
বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বিলের মাধ্যমে ৪৫২ কোটি টাকা উঠিয়ে নেয়। এদিন নতুন করে ৯০ ও ১৮০ দিন মেয়াদি বিল চালু করে তার মাধ্যমে টাকা তোলা শুরু করা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। তারা বলেন, এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে কিছু টাকা চলে আসে।
সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, কোনো কোনো ব্যাংকের গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি বদ্ধপরিকর। প্রত্যেক আমানতকারী এটা মনে করুক যে ব্যাংকেই তাদের টাকা থাকুক তা নিরাপদ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করবে-এমন প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি।
আহসান মনসুর বলেন, রোববার থেকে সব ব্যাংকে চাহিদা মোতাবেক টাকা পাওয়া যাবে। যে কারণেই অস্থিরতা হোক না কেন সেই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সমাধান করবে।
”বাংলাদেশ ব্যাংক টাইট মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এটা এভাবেই টাইট থাকবে। এতে গ্রাহকরা টাকা পাবেন, বাজারকেও অস্থির করা হবে।”
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ টাকা তুলে নেওয়া হবে বলে তুলে ধরেন তিনি।