বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে। প্রায় ৬ ঘণ্টা জ্বলার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে রাত ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
দেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে এত বড় আগুনের ঘটনা কীভাবে ঘটলো, এটা নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা? এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলসহ সাধারণ মানুষের মাঝেও আলোচনা, কৌতূহল ও প্রশ্ন রয়েছে।
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনার পেছনে আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট কাজ করেছে। সেখানে ১৮টি ইউনিটের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবিও আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও জানা সম্ভব হয়নি।
সচিবালয়ে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে রাত ৩টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী নিহত হয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম ।
মৃত ফায়ার সার্ভিস কর্মীর নাম মো. সোহানুর জামান নয়ন। তিনি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার মো. আক্তারুজ্জামানের ছেলে। সোহানুর তেজগাঁওয়ে স্পেশাল ইউনিটে কর্মরত ছিলেন।
এদিকে বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৭ নং ভবনে আগুনের ঘটনার পর উদ্ধার সহায়তায় ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে জরুরি বৈঠকে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারা অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস খুঁজে বের করে আগামী তিন দিনের (রোববার) মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট দেবে’। এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- গৃহায়ন সচিব, পুলিশের আইজি, কমিটির সদস্যসচিব থাকবেন ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের প্রধান, সশস্ত্র বাহিনীর একজন বিষ্ফোরক বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েট থেকে ৩ জন বিশেষজ্ঞ- একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন ইলেট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সরকার খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। যে কারণে স্বরাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই ঘটনার অবশ্যই সুষ্ঠু এবং বিস্তারিত তদন্ত হতে হবে। তদন্ত মোতাবেক আমরা অবশ্যই এমন সিদ্ধান্ত নিবো, যাতে এ ধরনের ঘটনা আগামীতে আর না ঘটে।
তিনি জানান, তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্টের পর চূড়ান্ত রিপোর্টও দ্রততার সঙ্গে করা হবে এবং সেই রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমসহ সকলকে জানানো হবে।
সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ফৌজদারি অপরাধ করেছে- এমন অনেকের বিরুদ্ধে সরকার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে এই প্রশ্নের উত্তরে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কাউকে এখানে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাউকে অপরাধী সাব্যস্ত করার আগে তার বিরুদ্ধে একটা তদন্ত করতে হয়। তদন্তের কাজ করে ইতোমধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অনেককে চাকরি থেকে সরানো হয়েছে, কাউকে ওএসডি করা হয়েছে। কেউ কেউ এখন কারাগারে আছে’।
তিনি আরও বলেন, কেউ একজন দাগি আসামি আছে- তাকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে, এমন কোনো ঘটনা নেই। আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে়র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানান, ৫টি মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়ে গেছে এবং অন্যান্য ক্ষতি হয়েছে। এগুলো হলো- ডাক ও টেলিযোগাযোগ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, সড়ক ও যোগাযোগ বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ।
এক প্রশ্নের উত্তরে আসিফ মাহমুদ বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের পিরোজপুরে একটি প্রকল্পে অর্থ লোপাটের প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জেল হোসেন মিয়ার সম্পৃক্ততার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় (এলজিআরডি) এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আমাদেরকে (অন্তর্বর্তী সরকার) ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকুক তাদের কাউকেই বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।
উপদেষ্টা বলেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থ লোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল।
সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ষড়যন্ত্রমূলক বলে উল্লেখ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মো. সারজিস আলম। তিনি বলেন, সচিবালয়ের ভেতরে কীভাবে একটি কুকুর পাওয়া যেতে পারে। এখানে আরও কোনো চক্রান্ত আছে কিনা? ষড়যন্ত্র আছে এটা আমরা নিশ্চিত। কীভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা চলছে। সেটিও আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে পর্যবেক্ষণ ও প্রতিহত করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সচিবালয়ের বড় আমলারা খুনি হাসিনাকে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছিল উল্লেখ করে সারজিস আলম বলেন, আমলাদের একটা বড় অংশ বিগত ১৬ বছরের সকল অন্যায় অপকর্মকে বৈধতা দিয়েছে। এদের একটা বড় অংশ দেশের সরকারি অফিসগুলোতে খুনি হাসিনার পারিবারিকতন্ত্র চালিয়েছে। রেফারেন্স, স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে, দলীয়করণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে প্রত্যেকটা সরকারি অফিস দলীয়করণ হয়ে গিয়েছিল।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম আরও বলেন, ‘আগুন লাগা দুই রুমের মধ্যে দূরত্ব ১০০ মিটার। এটা কীভাবে সম্ভব। আগুন একটা নির্দিষ্ট এলাকা থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে। এটাই হওয়ার ছিল। কিন্তু এমন দুটি রুমে আগুন লেগেছে যে দুটা রুম অভ্যুত্থানের সহযোদ্ধাদের। যারা এখন বর্তমান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামের রুম।’